সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে ৬৫ হাজার ভবনের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবনের অধিকাংশই ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে নির্মিত। নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে নির্মাণকাজ করায় কয়েক বছর পর ভবনগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এসব জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ভবনেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে লাখো শিশু।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ভবনগুলোর কোনোটির পিলার নড়বড়ে, কোনোটির ছাদ বা দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভবনগুলোর ছাদের অবস্থাও খুব নাজুক। পলেস্তারা উঠে বেরিয়ে পড়েছে রড। নতুন অনেক ভবনের দরজা-জানালাও নেই। সম্প্রতি সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় বিদ্যালয়ের বসার চেয়ার-টেবিলসহ আসবাবপত্র এবং অবকাঠামোর অবস্থাও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) থেকে জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে ১৯৯০ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদফতরের (এলজিইডি) সঙ্গে ডিপিই’র চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণকাজের দায়িত্ব পায় এলজিইডি।
দেখা গেছে, ওইসব ভবন নির্মাণ করার ৫ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ফাটল ধরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ অনেক স্থানে এসব ভবন ভেঙে পড়ারও খবর পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ভবন নির্মাণে বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় হলে কিছুতেই তা ৫০ বছরের আগে সংস্কারের দরকার পড়ে না। ভবন ভেঙে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে, রড ছাড়া কাঠ-বাঁশের ব্যবহার এবং যথাযথ পরিমাণ বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার না করা। সারাদেশে এমন ১১ হাজার ৮৬৯টি বিদ্যালয় জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নতুনভাবে সেখানে ভবন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থ অপচয় হচ্ছে।
ডিপিই ও মাঠপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডির ভবন নির্মাণের সময় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। নির্মাণ শেষে স্কুলের পরিচালনা কমিটি এবং প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরে ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। গোটা কাজ তদারকি করেন উপজেলা প্রকৌশলী। সার্বিক দায়িত্বে থাকেন সংশ্লিষ্ট ইউএনও। তবে হস্তান্তরের পর এসব ভবন রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও তদারকির ভার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) জেলার গোটা শিক্ষার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকার পরও প্রাথমিকের ভবনগুলোর মরণ ফাঁদে পরিণত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে এলজিইডি’র দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে সেই অনুযায়ী ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। নির্মাণের পর তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের পর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভবন বুঝিয়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষকে ভবন হস্তান্তরের পর তা মনিটরিং করা হয়। কোনো ধরনের ক্রটি দেখা দিলে তা মেরামত করে দেয়া হয়। তবে অনেক সময় দু-একজন ঠিকাদার সঠিকভাবে কাজ না করায় ভবনের নানা ধরনের সমস্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ধরনের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ৬ এপ্রিল বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের বিম ভেঙে পড়ে এক ছাত্রী নিহত এবং নয়জন আহত হয়। চলতি বছরের আগস্ট মাসে বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার বৈঠাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণের কয়েক মাস পর তা ভেঙে পড়ে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সেটিকে নিষিদ্ধ করেন ওই জেলার প্রধান প্রকৌশলী।
জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের (পিইডিপি-৩) আওতায় ২০১০ সালের মধ্যে নির্মিত যে ১১ হাজার ৮৬৯টি ভবনকে জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে তিন সহস্রাধিক ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিপিই। এটির অনুমোদন নিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বিদায়ী মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, একটি মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনগুলো তৈরি হয়ে থাকে। কিছু ঠিকাদার অতি মুনাফার লোভে অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ভবন নির্মাণ করে। সেসব ভবন বেশিদিন ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা এলজিইডি-কে চিঠি দিয়ে থাকি, একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যেখানে যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে তা করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আর কোনো জরাজীর্ণ ভবন থাকবে না।
উল্লেখ্য, দেশে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের মধ্যে ৩৬ হাজার ১৬৫টি পুরনো। এসব জরাজীর্ণ ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ২৬ হাজার স্কুল ভবন নতুন।