• এপ্রিল ২৭, ২০২৪ ৭:০৩ অপরাহ্ণ

কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক দলের পদে সরকারি শিক্ষকরা! 

আগ ২০, ২০২৩

সরকারি চাকুরি করে সরাসরি রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত থাকার সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পদে যুক্ত হয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অনৈতিক সুবিধা নিতে শিক্ষকদের এমন রাজনৈতিক দলের পদে থাকার তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার দাবী উঠেছে। শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ^াস দিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী।  

দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক দলসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনের সাবেক এবং বর্তমান কমিটিতে একাধিক নারী-পুরুষ শিক্ষক গুরুৎপূর্ণ পদে রয়েছেন। সরকারি চাকুরি করে অনেকেই রাজনৈতিক পদ পেতে তথ্য গোপন করে বিভিন্ন পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। আর এসব পদ-পদবি ব্যবহার তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ও সরকারি সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন অনায়সে। সরকারি চাকুরি করেও দলের প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা ও স্থানীয় প্রশাসনকে চাপে রাখছেন সুবিধাভোগীরা। এতে করে সাধারণ মানুষের নিকট দল এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে দাবী করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার দাবী স্থানীয়দের।  

কুড়িগ্রাম ফুলবাড়ি উপজেলার ফকিরের কুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক মিলন। তিনি সহকারি শিক্ষকের পাশাপাশি ফুলবাড়ি উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। একই উপজেলার পূর্ব কুরুষা ফেরুষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান মুকুল উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক পদ ধরে আছেন। নিজের শিক্ষকতা পেশাকে গোপন করে নারী উদ্যোক্তা পরিচয়ে নাগেশ^রী উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের পদ নিয়েছেন রায়গঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ইসমত আরা সেফু। মুনিয়ার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা কেয়া জেলা মহিলালীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদিকা পদে ছিলেন। তার বিদ্যালয়ের এক নারী সহকর্মী গর্ভবতী না হয়েও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সেই নারী শিক্ষককে মাতৃত্ব ছুটি দেন। বিদ্যালয়ের সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎসহ বিদ্যালয়ে নিয়মিত না এসে রাজনৈতিক কর্মকান্ডেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায় নেতাদের পরিচয় দিয়ে নেতাকর্মী এবং সহকর্মী ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের লাঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চিলমারী উপজেলা মসজিদের পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবদুস সাত্তার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে এবং রাণীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুঠির গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়নাল হকসহ জেলায় আরও অনেক শিক্ষক প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অঙ্গ সংগঠনের পদ পদবিতে থাকার তথ্য উঠে আসে। 

জেলা মহিলা আওয়ামী  লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনি তরফদার জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে খাদিজা সুলতানা কেয়া থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন খাদিজা নিয়মিত স্কুল যায় না। সে কেন্দ্রীয় নেতাদের পরিচয় বহন করে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ববৃন্দসহ সরকারি কর্মকর্তা ও তার স্কুলের সহকর্মীদের কোণঠাসা করে রাখেন। সেই প্রভাব বিস্তার করে কিছুদিন আগে আমাকেও লাঞ্চিত করেছেন কেয়া। 
প্রভাষক আবদুল কাদের বলেন, শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নয় জেলার বিভিন্ন সরকারি বিভাগের কর্মরত চাকুরিজীবীগণ জেলা ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় রাজনৈতিক দলের গুরুৎপূর্ণ পদে রয়েছেন। তারা ব্যক্তি স্বার্থে দল ও সরকারি সুযোগ সুবিধা আদায় করে থাকেন। ফলে স্কুলগুলোতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে নাগরিকরা সঠিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন সাধারণ মানুষের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়। 

নাগেশ^রী উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও সহকারি শিক্ষক ইসমত আরা সেফু প্রতিবেদকের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বলেন,আমি রাজনীতি করি কিনা আপনাকে জানাতে বাধ্য নই। 

রায়গঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হানিফা বলেন, ইসমত আর সেফু রায়গঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকলেও রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি তার জানা নেই। 

ফুলবাড়ি উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সহকারী শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক মিলন শিক্ষক ও দলীয় পদে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন,পদে থাকলেও নির্বাচনসহ সরকারি কাজে কোন ধরনের প্রভাব তিনি বিস্তার করেন না। দলের বিপদের সময় তিনি এই উপজেলা যুবলীগের হাল ধরেছেন। 

উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান মুকুল বলেন, চাকুরি সরকারি হবার আগে তিনি দলীয় এই পদে রয়েছেন। এখনও পদ থেকে পদত্যাগ করেননি বলেও জানান। তবে আগামীতে কী করবেন তার কোন সদুত্তর দিতে পারেনি বিএনপি’র এই নেতা। 

রাণীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক আয়নাল হক বলেন, আমি সরকারি চাকুরি করে দলকে প্রাধান্য দেই না। যখন দলীয় পদে আসছিলাম তখন চাকুরি সরকারি হয়নি। এরপর আর কাউন্সিল না হওয়ায় এখনও সেই পদে রয়েছি। আগামীতে দলীয় পদে থাকবো না।

চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সহকারি শিক্ষক আবদুস সাত্তার পদে থাকার কথা নিশ্চিত করলেও সরকারি চাকুরি করে দলীয় পদে থাকার বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কুড়িগ্রাম শাখার সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর সভাপতি অ্যাড: আহসান হাবীব নীলু বলেন, জেলায় সরকারি চাকুরিজীবীরা সরকারি দল ও বিরোধী দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে রয়েছেন। একই সাথে সরকারি চাকুরি করে রাজনৈতিক দলের পদে থাকা আইনসিদ্ধ না। এটা পুরো বেআইনি। তারা রাজনীতি করার কারণে প্রশাসনের উপর হস্তক্ষেপ করেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। এতে করে স্কুলের পাঠদান ও নাগরিক সেবা বিঘিœত হচ্ছে। এই প্রচলন বন্ধ হওয়ার দরকার বলেও তিনি দাবী করেন। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন দাবী করে তিনি বলেন, যদি কারও বিরুদ্ধে দলীয় পদে থাকার সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে