সাভারের তাজরীন ফ্যাশন হাউজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন মধ্যবয়সী নাছিমা আক্তার। কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের পর মেরুদণ্ডের সমস্যায় কাজ হারান তিনি।এরপর একটু সুস্থ হলে গৃহকর্মী হিসেবে বাসা-বাড়িতে কাজ শুরু করেন। সেখানকার উপার্জন দিয়ে চলছিল ভালোই। তবে করোনা পরিস্থিতিতে হারাতে হয় সেটিও।
সম্প্রতি বাধ্য হয়েই তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে শামিল হন তিনি।
কথা হলে তিনি বলেন, আমাদের এখন বাড়ি-ঘর নেই, বলা যায় পুরো ভূমিহীন। মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণে অন্য কোথাও কাজও করতে পারি না। আগে বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতাম, করোনার জন্য এখন সেটিও বন্ধ। করোনার এই সময়ে আমাদের সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
একই অবস্থা হালিমা খাতুন নামের আরেকজন শ্রমিকেরও।
তিনি বলেন, আগে কাজ যা করা করতাম, করোনার কারণে তা হারিয়েছি। আর কাজ হারিয়ে অবস্থা এতটাই খারাপ যে, মাঝেমধ্যে নিজের বাচ্চার খাবার যোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হয়।
শুধু নাসিমা আক্তার বা হালিমা খাতুন নয়, করোনা পরিস্থিতিতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের শ্রমজীবী নারীদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা। পোশাক শিল্প, জুতা তৈরি, ব্যাগ তৈরি, গৃহকর্মী, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেলের রান্নাসহ বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন যেসব নারী শ্রমিকেরা, করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সমস্যায় এমন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী নারীরা এখন দীর্ঘসময় ধরে গৃহবন্দি। তাদের বেশির ভাগেরই কাজ নেই, বেতন বন্ধ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ সময়ে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতাও।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সমীক্ষা বলছে, করোনার কারণে সাধারণ ছুটিতে কারখানা বন্ধ আছে বলে শতকরা ১৮ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজে যোগ দিতে পারছেন না। এদের সামান্য একটি অংশ বেতন পেলেও অধিকাংশেরই বেতন বন্ধ। আর সীমিত পরিসরে কারখানা চালু হলেও নারী শ্রমিকেরা আছেন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। অনেকে চাকরিচ্যুতও হয়েছে, এর পরিমাণ শতকরা ১৬ শতাংশ এবং সাময়িকভাবে ছাঁটাই হয়েছে ২০ শতাংশ নারী শ্রমিক।
এদিকে গৃহকর্মী হিসেবে যারা কাজ করতেন তাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বাসা-বাড়িতে আপাতত কাজে নিচ্ছেন না গৃহমালিকেরা। বেতন বন্ধ বা আংশিক বেতন থাকায় শতকরা ৫২ শতাংশ নারী আর্থিক সংকটে আছেন।
অন্যদিকে নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা সর্বোচ্চ করোনা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঘরে খাবার না থাকায় নিম্নমানের জীবনযাপন করছেন শতকরা ৩০ শতাংশ এবং পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারছেন না ২৮ শতাংশ নারী। এমতাবস্থায় সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বহন করা যেমন একদিকে কষ্টকর হচ্ছে, তেমনি শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের প্রবণতাও বাড়চ্ছে।
আরও গুরুতর বিষয় এই যে, করোনার কারণে শুধুমাত্র নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ক্ষতিই হচ্ছে না, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতাও।
সমীক্ষার তথ্যমতে, শতকরা ৬৭ শতাংশ শ্রমজীবী নারী জানিয়েছেন, করোনাকালীন পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে। প্রতিবেশীর কাছে বার বার সাহায্যের জন্য যাওয়ায় লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে অনেকেই। এছাড়া বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে চলে যেতে হুমকি দিয়েছেন এবং আর্থিক সহায়তা ও কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শ্রমজীবী নারীরা শিকার হয়েছেন নির্যাতনেরও।
মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, উদ্বেগজনক হলো করোনাকালীন নারীরা ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হলেও খুব অল্প সংখ্যক নারীই নির্যাতনের ঘটনায় অভিযোগ করেছেন। এর কারণ হিসেবে রয়েছে পুনরায় নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয় ও বাড়িছাড়া হওয়ার ভয়। এটি ভুক্তভোগী নারীদের হতাশা, বিষন্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। কেননা লকডাউন চলাকালে বিকল্প নিরাপদ আবাসস্থল পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বোপরি করোনা সংক্রমণে আক্রান্তের হিসেবে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কম হলেও এর কারণে সৃষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতসমূহ নারীদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে আরও প্রান্তিক করে তুলেছে। আর এটি পরবর্তীতে নারীর অগ্রগতিকে আরও বাধাগ্রস্ত করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ বা নারী শ্রমিকদের জন্য তাদের কর্মস্থল কিভাবে আরও উপযোগী করে তোলা যায়, সেটি বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, পৃথিবীব্যাপী যেকোনো দুর্যোগে নারীরা বেশি আক্রান্ত হয়। অথচ নারীদের সুরক্ষায় যে জেন্ডার বিভাজন ডাটা থাকা দরকার সেটি কখনোই গুরুত্ব পায় না। অথচ সেই বিষয়ে আমাদের আরও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের সেফটি নেট কর্মসূচির পরিধি বাড়াতে হবে। কোভিডের কারণে যেসব শ্রমজীবী নারী কর্মহীন হয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছেন, তাদের সেফটি নেটের আওতায় আনা প্রয়োজন। এছাড়া শ্রমজীবী নারীদের কর্মে ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। আর শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধে বিভিন্ন প্রণোদনা, বৃত্তি দিয়ে বা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু করে তাদের শিক্ষার মধ্যে ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া, পোশাকশিল্পে নারী-শ্রমিকদের চাকরি সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া এবং করোনাকালীন নারীর স্বাস্থ্যসেবা সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়াসহ নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ সরকারের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে বাজেট বাড়ার প্রতিও এ সময় গুরুত্বারোপ করেন তিনি।