• নভেম্বর ২১, ২০২৪ ১২:২৪ অপরাহ্ণ

Sakaler Kagoj

The Most Popular News Portal

ঢাকার ভানু অন্য ভানু

সেপ্টে ১২, ২০২০

‘কে গো জানতে পায় রসের রসিক না হইলে।’- লালনের গান। এই লোকায়ত অধ্যাত্ম-কুসুম আমাদের জীবন কতোটা বটের মতো বহুবিস্তারি, এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। রস, রসিক আর জানার ব্যাপারটার মধ্যে একটি গভীর ও পারস্পরিক যোগসূত্র আছে। অনেক ভাবেই জানানো যায়, তত্ত্ব ঘেঁটে জানানো যায়, গল্পে গল্পে জানানো যায়। মাধ্যম পরিবর্তন করে, নাটক, চলচ্চিত্র, কথাসাহিত্য বা চিত্রকলায় জানানো যায়। যেমন করেই জানানো হোক, হাসাতে হাসাতে জানাতে পারে ক’জন? হাসাতে হাসাতে কাঁদাতে পারে ক’জন!

অনেক কথা, তথ্য বা সংবাদ আছে যা উগরে দিলেই বিপাকে পড়তে হয়। যেভাবেই কথাটা বলা হোক, তা পাকে মাখিয়ে যায়। হিউমার সেন্স বা হাস্যরসের কৌশল রপ্ত থাকলে অবলীলায় কথাটি বলে দেওয়া যায়। তাতে সংবাদের অনিবার্য নির্যাস নেওয়া যায়, কাঁটার আঁচড় ছুঁতেও পারে না।

‘ঢাকার ভানু’ তার অনন্য ‘ভোকাল আর্ট’ দিয়ে কৌতুক পরিবেশনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এইচএমভি’র পাথুরে রেকর্ড পার হয়ে এক সময় তা অডিও টেপের যুগে আসে। আজও তা সমান জনপ্রিয়; আমরা শুনি- এমপিথ্রি। এখন এমপিথ্রি’র কালও শেষ হবার পথে। প্রযুক্তির পরিবর্তনে কলের গান, ক্যাসেট প্লেয়ারের জেনারেশন শেষ হয়ে গেছে। ঢাকার ভানু’র জেনারেশন শেষ হয়নি। আজও সে লোকমুখে প্রচারিত। শুধু জনপ্রিয় নয়, জননন্দিত। আজও তার কণ্ঠ ভাসে ওয়েবে, ইউটিউবে। এ প্রজন্ম তার কৌতুকে রসের খোরাক পায়। আবেদনের ইউনিভার্সিলিটি বা চিরন্তন উপযোগ আর অনুভব না থাকলে তা সম্ভব হতো না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুকরসে স্ক্রিপ্ট-ফরম্যাট বা চিন্তায় প্রবল ভাবে ইতিহাসের পরিবর্তন, ভাঙচুর, দুঃখ-বেদনা, সমাজ-রাজনীতির মোচড় ধরা পড়েছে। কলার মোঁচার মতো অথবা সুদৃশ্য প্রাকৃতিক শঙ্কুর মতো তিনি তা অডিয়েন্সের পাতে পরিবেশন করেছেন। প্রতিদিনের ঘটনা যা নিত্যচেনা, যা পরিবারে ঘটছে, পথের মোড়ে, সড়কে, যানবাহনে বা সওদাগরি অফিসে ঘটছে তার ভেতরের বৈষম্য বা দ্বন্দ্ব অবলীলায় মুঠো খুলে তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন। দর্শক শ্রোতা হাসছে। হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরছে। পিঠে কিল মেরেও সে হাসি থামানো কষ্টকর!

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, কৌতুকের পাত্র-পাত্রী তারাই। ওই কৌতুকের কেচ্ছাটিও তাকে নিয়ে, আমাকে নিয়ে বা আমাদের নিয়ে। এবং তার মূল স্বর চিরকালীন। তাই শতবর্ষ পেরিয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি খুঁজতে হয় না। তার বাড়ি, তার ঠিকানা আমাদের অন্তরের ঘরবাড়িতে।

ভাঁড়ামো আর ন্যাকামো দেখলেই বাঙালি নাক সিঁটকায়। সানুনাসিক শব্দ উচ্চারণ করলে আমরা তার নাম ন্যাকার খাতায় ওঠাই। অথচ ভুলে যাই, বাংলা বর্ণমালায় একাধিক সানুনাসিক শব্দ আছে। যথেষ্ট সত্য উন্মোচনের পরও তথাকথিত ‘ভাঁড়ামো’ জাতে ওঠে না। কৌতুক হলেই তা যেন একটু সস্তা, একটু হালকা-পলকা। অথচ পৃথিবীর গুরুভার উচ্চারণগুলি হিউমার বা হাস্যরসের মোড়কে মোড়ানো। হিউমার বা হাস্যরসের সঙ্গে আমরা ভাঁড়ামোকে গুলিয়ে ফেলি। শিল্প-সাহিত্য, নন্দনতত্ত্বের কোনো ক্ষেত্রেই তা ‘সিরিয়াস’ বলে ঠাঁই পায় না। এ যেন নিছক হাস্যরস, শুধুই হাসির খোরাক, সারবস্তু বলে সেখানে কিচ্ছু নেই।

হাস্যরস, রসরচনা, রসের খোরাক, রম্যকথা বা রম্যরচনা- সবই শেষ বিচারে আমাদের কাছে ভাঁড়ামো। ওসব দেখেশুনে হেসে গড়াগড়ি দেওয়া যায়, মূল্যবিচার করে তাকে তাকিয়ায় স্থান দিতে আমরা রাজি নই। এই স্ববিরোধিতা বাঙালির চরিত্রে আছে। মননশীলতার গভীরে এক অদৃশ্য ঘুণপোকার মতো আছে। ঘুণপোকাই তো, যেহেতু হাস্যরসের শাঁসালো সংবাদটি খেয়ে খোলসটি ভাঁড়ামো বলে তাকে পথে ছুঁড়ে দেওয়ার সংস্কৃতি। ওই ছুঁড়ে দেওয়া খোলসেও আরেকজন আছাড় খায়।

ভানু আর ভাঁড়ামো এক কথা নয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কৌতুকরসকে জীবনের অন্ধিসন্ধিতে চালান করেছেন। অথবা বলা যায়, হাস্যরসের দীঘির জলে তিনি জীবনের জলছবি এঁকেছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রবাদপ্রতিম চার্লি চ্যাপলিনের উপমহাদেশীয় স্টেরিয়োটাইপ বললে হয়তো অতিকথন হবে না। ‘মডার্ন টাইমস’ বা ‘দ্য গোল্ড রাশ’-এর নির্মাতা ও অভিনেতাখ্যাত চ্যাপলিনকে আমরা ‘চার্লি চ্যাপলিন’ বলেই জানি। ‘চার্লি’ শব্দটি স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিনের নামের আগে থেকে ছেঁটে দিলে তিনি অপরিচিত হয়ে যাবেন না। জাত-কুল-মান খোয়াবেন না। অতো বড় মেধাকে ‘চার্লি’ বললে একটু অবিচার করা তো হয়ই। কারণ ইংরেজি চার্লি শব্দটির মধ্যে বাংলা ভাঁড়ের গন্ধ পুরোমাত্রায় আছে। সময় বদলেছে, মানুষের মনোভঙ্গিও বদলেছে। মহান চ্যাপলিনকে ‘চার্লি’ বলে চালিয়ে দিয়ে নিজেদের মর্যাদায় কুড়াল না মারাই ভালো। কবে কখন স্যার চ্যাপলিনের আগে ‘চার্লি’ শব্দটি বসে গেছে, তা কে জানে? ভাগ্যিস ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে আমরা ‘ভাঁড়’ বসাইনি। এ নিয়ে আমরা বাঙালিরা এক বিঘত বেশি গর্ব করতেই পারি!

শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’-এর বাংলা অনুবাদ প্রথম করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর- ভ্রান্তিবিলাস। নামের অনুবাদ লাগসই। এই কমেডি চলচ্চিত্রায়ন হলে, সেখানে দ্বৈত ও দ্বান্দ্বিক চরিত্রে অভিনয় করেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। মহানায়ক উত্তম কুমারের সমান্তরালে। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘আশিতে এসো না’ বা এ ধরনের অনেক চলচ্চিত্র তথাকথিত পপুলার হলেও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ অবশ্যই ভিন্ন কথা বলে। সাড়ে চুয়াত্তর হাস্যরসে জীবনের ধ্বনিময় ধারাপাত। অনেকটা তলিয়ে দেখতে হয়। কারণ করুণ রস চিত্ত শুদ্ধি করে। কথাটি সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অঙ্কুরিত, বিস্তারিত ও সংস্কারে পরিণত হয়েছে। সিনেমা হল আজ উঠে গেছে। মাল্টিপ্লেক্সের যুগ। তবুও ওই সনাতন সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে বিয়োগান্ত পরিণতি ছাড়া চলচ্চিত্রকে আমরা সিরিয়াস বলতে রাজি নই। কমেডিকে আমারা উপভোগ করি যতোটা, অবচেতন মনে উপেক্ষা করি তার চেয়েও বেশি। বিয়োগান্ত পরিণতি ছাড়া তাকে আমরা সিরিযাস ভাবতেই পারি না।

পশ্চিমে অর্থাৎ ইয়োরোপ বা নর্থ আমেরিকায় পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার গুণপনার একটি হিসেব জুড়ে দেওয়া হয়, ‘হি হ্যাজ গুড সেন্স অব হিউমার’। সরল কথায়, পাত্রটির রসবোধ আছে। কন্যাও ওই কথাটি শোনার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকে। কেন থাকে- তার কারণ অনেক। একজন রসালো পাত্র অনেক পার্থিব জটিলতা মুক্ত হয়। ইহজাগতিক দ্বন্দ্ব বা জটিলতাকে সে মনুসংহিতা দিয়ে বিশ্লেষণ না করে হাস্যরসের খোরাক দিয়ে তরল করে ফেলতে পারে। পরিবারে বা দাম্পত্য সম্পর্কে ঝড়ের পরিবর্তে রসধারায় যে সমস্যা নিরসন করতে পারে যে, সেই তো উপযুক্ত পাত্র। একথা একজন বিবাহে উন্মুখ কন্যাও জানে।

বার্নার্ড শ’র কথা আমরা সবাই জানি। একজন স্যাটায়ারিস্ট। গোড়ার কথাটি হলো হিউমার। রসবোধ। তাছাড়া স্যাটায়ার করা সম্ভব নয়। ‘নাইন সোলজারস আউট অব টেন আর বর্ন ফুল’, কথাটি একজন সৈনিকের মুখ দিয়েই তিনি উচ্চারণ করিয়েছেন। ১৮৮৫ সালে সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার মধ্যে যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এ নাটক তীব্র ব্যঙ্গ উচ্চারণে যুদ্ধের সারবত্তাহীন খোল-নলচে খুলে দেখিয়ে দেয়। শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ’ বা চ্যাপলিন, সবার প্রচ্ছায়া খুঁজে পাওয়া যাবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে। তাদের সবার কাছে ভানু তালিম নিয়েছেন, এমন ভাবার কারণ নেই। এটা সহজাত। শিল্পবোধ জীবন সম্পৃক্ত। এবং জীবনের ভাষা একই। তাই জীবনমুখীনতার প্রশ্নে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য এক হয়ে যায়। যদি তাই না হতো তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশের বাঁশঝাড়ে ইন্দির ঠাকরুনের করুণ মৃত্যু ও ঘটি গড়িয়ে যাওয়ার শটে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসব চিরায়ত মানবিক আবেদনের দলিল খুঁজে পেতো না।

‘দ্যাশ বিভাগের পর ল্যান্ড তো গেল, পইড়া রইল লর্ড। ‘লর্ড’রে রাখি কই! নামের গোড়ায় লাগাইয়া লইছি।’ এই কৌতুক কতোটা স্যাটায়ার আর কতোটা নিছক কৌতুক তা এতোকাল পরেও বিবেচনার দাবি রাখে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একইসঙ্গে ভোকাল অ্যাক্টর এবং মুভি অ্যাক্টর। দুই ক্ষেত্রেই তিনি সমান সফল।

ইংরেজি কমেডিয়ান শব্দের অনেকগুলি সমার্থক শব্দ আছে। ক্লাউন, কমেডিয়ান, বাফুন- এগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাফুন (Bafoon) চরিত্রগুলির প্রায়ই দেখা মেলে শেক্সপিয়রের নাটকে। আর সবচেয়ে শক্তিশালী বক্তব্যগুলো তিনি ওই বাফুনদের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নিয়েছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তার কৌতুকে সুযোগ পেলেই নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘ঢাকার ভানু’ হিসেবে। এটা কী বাকভঙ্গিমায় রস বাড়ানোর জন্য, নাকি তার শেকড় চিহ্নিত করার প্রয়াস- তাও ভাবনায় এসে যায়।

চলচ্চিত্রে সংলাপের ক্ষেত্রে তিনি ‘ঢাকাইয়া’ ভাষা ব্যবহার থেকে পিছ-পা হননি। ফলে দেশ বিভাগের পরও তার সংলাপ, কৌতুকের ভাষা আমাদের কাছে সহজবোধ্য ও আত্মীয়তুল্য। এই আত্মীয়তার মধ্যেই কি তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন! করুণ রস শুধু চিত্ত শুদ্ধি করে না। যাকে আমরা তামাশা বলি তা দিয়েই ‘তমশ’ বা ঘনিভূত অন্ধকার উন্মোচন করা যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তাই একশ’ বছর পরও তার বাড়ি আমাদের মনস্তত্ত্বে। আমাদের অন্তরে।

গবেষকদের মতে, ড্রামাটিক টেনশন থেকে স্বল্পকালের জন্য মুক্তি দেওয়ার জন্য শেক্সপিয়র নাটকে বাফুন, ফুল বা বোকাদের আমদানি করেন। অনেকটা কমিক রিলিফের মতো। কিন্তু শেক্সপিয়রিয়ান বাফুন বা বোকা চরিত্রগুলি স্বভাবে, চরিত্রে স্বতন্ত্র ও অনন্য। ‘They are An Interpretation of Their Wit, Wisdom and Personalities’. তারা ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের প্রবক্তা। নিছক ভাঁড়, বোকা, বা কমেডিয়ান নয়। শেক্সপিয়র তাদের অন্যমাত্রায় উন্নীত করেছেন। এবং বলেছেন, ‘‘আমি বলছি, ‘অজ্ঞতা-ভিন্ন কোনো অন্ধকার নেই।’’ ভানু হলে হয়তো বলতেন, আরে ভাই, আমি কইতাছি ওইখানে কোনো অন্ধকার নাই। কী মুশকিলের কথা ওইখানে তো আপনি যানই নাই।

আবার দেখুন, শেক্সপিয়র বলছেন, ‘মহান হতে ভয় পেও না।’ ভানু হলে হয়তো বলতেন, ডর লাগতাছে বুঝি! মহান কথাটা জানেন তো! আমি ঢাকার ভানু কইতাছি, মহান হইতে কারো পয়সাও লাগে না। ডর লাগলে কাইটা পড়েন। আর পয়সা এইখানে দ্যান। টিনের বাক্সে বারো টাকা।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বিভিন্ন চরিত্রে উপস্থাপিত করেন। ঘটনা পরম্পরায় তিনি এই বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটান। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করলে, মনে শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ’ বা চ্যাপলিন ভিড় করতেই পারে। কারণ চিন্তন, অনুভব, উন্মোচন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি তাদেরই সমান্তরাল। ফলে প্রতীচ্যে যারা উইটি হিউমারের অনুশীলন করেছেন, প্রাচ্যে আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা তাদের স্টেরিয়োটাইপ হিসেবে পেয়ে যাই। জন্ম শতবার্ষিকীতে গতানুগতিক ভানুর ভিন্ন সুর ও ভিন্নস্বর সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর ‘ঢাকার ভানু’ আমাদের পড়শি, আমাদের পরমাত্মীয়। ভাঁড়ামো নয় রসবোধ বা হিউমার ব্যক্তিমানস সমাজ ও জীবন অণ্বেষণের বড় হাতিয়ার- এ কথা শিখিয়েছেন ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়। ঢাকার ভানু।

‘বোকা চরিত্র’ নির্মাণের সার্থকতা সেখানে, যেখানে বোকারা মোটেই বোকা নয়’। আইজ্যাক অসিমভ, গাইড টু শেক্সপিয়র। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের কক্ষপথে শুধু এ ধ্বনিই শোনা যায়। সমাজের চতুর মানুষের সামনে তিনি সরল, সাদাসিধে, বোকা মানুষটি হয়ে বসে থাকেন। ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চতুর মানুষটির অন্তসারশূন্যতা টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন। একজন ক্লাউন, বাফুন, ফুল, কমেডিয়ান নিয়ে আমাদের মধ্যে হয়তো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে কিন্তু হিউমারকে শিল্পের শক্তিশালী উপাদান হিসেবে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা তৈরি করলে বিভ্রান্তির অবলুপ্তির সুযোগ থাকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম শতবার্ষকীতে অন্তত এই দিকটায় আমরা মনোঃসংযোগ করতে পারি।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থাপন কৌশল সরল। ভাষা ও কণ্ঠশৈলী গার্হস্থ্য জীবনের মতোই সরল ও সহজবোধ্য। খুব সহজেই সকল প্রজন্মের সঙ্গে তা যোগসূত্র স্থাপন করে। সহজে বোধগম্য হয়। সর্বস্তরে কৌতুকরস পৌঁছানোর এই কৃতিত্ব ও কৌশলটিও তার নিজস্ব। উপরিতলের হাস্যরসের আড়ালে থাকে শাঁসালো সংবাদ যা ব্যক্তি, সমাজ ও সময়ের স্ববিরোধিতা, দ্বন্দ্ব বা অনাকাঙ্খিত উপাদানকে সামনে নিয়ে আসে, তা কখনও বেদনার মতো, কখনও প্রতিবাদ ও হাহাকারের মতো। এই কৃতিত্ব ও কৌশল নির্মিতির প্রশ্নে তার একান্তই নিজস্ব। ভোকাল অ্যাক্টিং বা কথা-কৌতুক এবং চলচ্চিত্র উভয় ক্ষেত্রেই তা সমান সত্য। চলচ্চিত্রে বাড়তি পাওয়া যায় তার উপস্থিতি। জেশ্চার, বডি ল্যাংগুয়েজ, এক্সপ্রেশন ব্যবহারে বাড়তি সুযোগ তিনিও পান। শ্রোতা-দর্শকও তাকে একটু বেশি পেয়ে যায়। শুধু অডিয়োতে কাজটি কঠিন ছিলো। তাও তিনি অবলীলায় করে দেখিয়েছেন। শ্রুতিমাধ্যমে কৌতুক পরিবেশনের সময় বিবৃতিধর্মী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম হয়েছে। শ্রুতিমাধ্যমেই তিনি দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন। শ্রোতাদের মনে হয়েছে, তারা শুধু শুনছেন না দেখছেনও।

ভিজ্যুয়ালাইজেশনের এই অনন্য কৌশলটি তার নিজস্ব ও সহজাত। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে চ্যাপলিন যেমন তার নিজস্ব ঢঙে শ্রুতির ঘাটতি কাটিয়ে উঠে উপরন্তু চলচ্চিত্রকে নিজস্ব জেশ্চারে অন্য ভাষা দিয়েছেন, ভানুও তেমনি। চ্যাপলিনের জেশ্চার অনন্য। তার দেহের ভাষা বা অভিব্যক্তি এক অর্থে প্রচলিত সবাক চলচ্চিত্রের ভাষাকেও অতিক্রম করে যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রুতি-কৌতুকগুলিও প্রচলতি ভিজ্যুয়ালাইজেশনকে অতিক্রম করে তাকে অন্যমাত্রা দেয়। কৌতুক পরিবেশনের ক্ষেত্রে তিনি উপমহাদেশের সংস্কৃতি, সামাজিক অবকাঠামো এবং ব্যক্তিমানুষের আনকোরা ও অতিপরিচিত উপাদান ব্যবহার করেছেন। ফলে খরতর নদীর জলের মতোই তা পৌঁছে গেছে সবার উঠোনে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কতোটা বিপ্লবী আর কতোটা বিদূষক, তার কর্মজীবন ঘাঁটলে কথাটি সামনে চলে আসে। ঢাকার ভানু বা সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২০ সালে জন্মেছিলেন বিক্রমপুরের মুন্সীগঞ্জে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে কমবেশি সবাই সচেতন। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির নেশায় একাধিক বিপ্লবীদলের জন্ম হয়েছিল ওই সময়ে যা সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলো। এক কথায় ‘স্বদেশী আন্দোলন’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। বিনয়-বাদল-দীনেশ এই সংযুক্ত ত্রয়ী নাম বিপ্লবীদের মধ্যে কিংবদন্তিতুল্য।

কলকাতা শহরের লালদীঘি-সংলগ্ন এলাকাটি ‘বিবাদী বাগ’ নামে পরিচিত। বিবাদ নয়, বিনয়, বাদল দীনেশ- এই তিন বিপ্লবীর নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে এই নাম কলকাতার হৃদয়। তিন বিপ্লবীর যুযুধান কর্মকান্ড তুলনারহিত। তাদেরই একজন দীনেশ গুপ্ত। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহচর ও শিক্ষাগুরু ছিলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর প্রযোজনার অর্থ দীনেশ গুপ্ত জুগিয়েছিলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিনয়, বাদল, দীনেশের জন্মও বিক্রমপুরে। ১৯৪১ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভানু পূর্ববঙ্গেই ছিলেন। তারপর পাকাপাকিভাবে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান।

ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন এই মানুষটি সুন্দর বেহালা বাজাতেন। কিন্ত জীবনের তারগুলি তিনি কাঁটা-কৌতুক দিয়েই বাজিয়ে গেছেন। জীবনের রঙ্গশালার রসিক মানুষটির উচ্চতা হয়তো খুব মনোযোগ দিয়ে আমরা মাপজোক করিনি।

সহায়ক তথ্যসূত্র:
Isaac Asimov, Guide to Shakespeare.
Twelth Night, William Shakespeare
সাক্ষাৎকারঃ প্রবীর চৌধুরী, সংস্কৃতিকর্মী, গীতিকার, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী
গ্রুপ ডিসকাসনঃ সুখেন পাল, সংস্কৃতি-অনুরাগী ও সমাজসেবী