সাওরাত হোসেন সোহেল, চিলমারী:
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা রাজারভিটা এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে বাসবাস লিপি বেগমের। জমাজমি বলতে শুধু বাড়িভিটা। এর উপর সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী স্বামীও চলে গেছে প্রায় দুই বছর আগে। স্বামী আলম বাদশা ছিল দিনমজুর। দিন আনে দিন খাওয়া সংসার এর উপর ছিলেন অসুস্থ। সংসারের টানাপোড়েন জন্য কাজের উদ্দেশ্যে ঢাকা গেলেও অসুস্থার কারনে হঠাতেই মৃত্য হয় তার। ২০২৩ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর টানাপোড়েন সংসারে ১ ছেলে লিমন মিয়া (১৯) ২ মেয়ে আখিতারা (১৭) ও আফিয়া আক্তার (৬) নিয়ে বড়ই বিপাকে পড়েন লিপি বেগম। সংসারে উপার্জন করার বা সংসারের হাল ধরার কেউ না থাকায় বড় মেয়ে আখিতারাকে বিয়ের বয়স না হলেও বিভিন্ন চাপ ও চিন্তার কারনে মেয়ের বিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত নেন, পরে আরডিআরএস চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্প মাধ্যমে বাল্য বিয়ের কুফল জানতে পেরে কষ্ট হলেও সংসারের হাল ধরেন এবং মেয়েকে বাল্য বিয়ে না দিয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন বলে সিন্ধান্ত নেন। সেই মতাবেক সেলাই মেশিন চালিয়ে আয় শুরু করেন এবং এই সময় আরডিআরএস বাংলাদেশ চাইল্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যমে দাতা সংস্থা এন আরকে টেলিথন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহযোগীতায় এককালিন ১৭ হাজার টাকার সাথে আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ নেন। পরে প্রকল্পের কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের পরার্মশে ছাগল পালন শুরু করেই এবং ধিরে ধিরে আয়ের পথ খুলে যায়। একদিকে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ ও অন্যদিকে ছাগল এবং হাঁস মুড়গি পালনে দেখেন আলোর মুখ। ১ বছরের মধ্যে তিনি গরু ক্রয় করেন এবং পালন করা শুরু করেন। গুরু, ছাগল ও হাঁস, মুরগি পালনে আয়ের পথও খুলে যায় এবং সংসারের অভাব অনটন দুর হতে শুরু করে। লিপি বেগম শান্তির ছায়ার এখন সুখের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। মেয়েকেও বাল্যবিয়ে না দিয়ে করাচ্ছেন পড়াশোনা। লিপি বেগম জানান, অভাব অনটনের সংসারে কষ্ট করে চললেও তার স্বামীর মৃত্যের পর যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গের পড়ে কোন কুল কিনারা পান না, পরে আরডিআরএস বাংলাদেশ এর চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের সহায়তায় আবারো ঘুরে দাঁড়ান এবং সফলতার মুখ দেখেন, তিনি আরো বলেন, ১ ছেলে ও দুই মেয়েকে পড়াশুনা করাবে এবং শিক্ষিত করে গড়ে তুলে দেশ ও দশের সেবার জন্য নিয়োজিত করবেন। শুধু লিপি বেগম নয় রমনা খামার এলাকার মঞ্জু মিয়ার স্ত্রী শাহানা বেগমের সংসার ১ ছেলে ও ৩ মেয়েকে নিয়ে তাদের সংসার। অভাবের সংসারে টানাটানির কারনে অল্প বয়সেই ২ মেয়ের বিয়ে দেন এবং ৩য় মেয়ে মুক্তা ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ার সময় বিয়ের সিন্ধান্ত নেন পরে চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যম্যে বাল্যবিয়ের কুফল জানতে পারেন এবং তাদের দেয়া ১৭ হাজার টাকা ও পরামর্শে ছাগল পালন ও সবজি চাষ শুরু করেন এবং সফলাতার মুখ দেখেন ধিরে ধিরে টাকা জমিয়ে স্বামীকে নৌকাও কিনি দেন। এখন মেয়ে মুক্তা পড়াশোনা করছেন আর সংসারে সুখের আলো ফুটতে শুরু করেছে শাহানার। এছাড়াও স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের সরদারপাড়া (মাঝিপাড়া) অবদা খাস জমিতে বসবাসরত মৃত মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী খোতেজা বেগম, পড়ে চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের দেয়া এককালিন ১৭ হাজার টাকা দিয়ে বাড়িতে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেলাইয়ের কাজও করেন বর্তমানে তিনি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। ইতি মধ্যে তিনি বড় মেয়েকে বিয়ে দেন এবং ছোট মেয়েকেও বাল্য বিয়ে থেকে বিরত রেখে পড়াশোনা করিয়ে শিক্ষক বানাতে চান। তথ্য মতে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ১৬২টি পরিবারকে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করায় উক্ত পরিবার গুলোর মধ্যে সচ্ছলতা ফিরছে এবং বাল্যবিয়ে থেকে মেয়েরা মুক্তি পাচ্ছে। সিএনবি প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ উপজেলা। এখানে বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ নদী ভাঙ্গন ও দরিদ্রতা। লিপি, শাহানাদের মতো হাজারো পরিবারে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে সিএনবি প্রকল্পের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল পরিবারগুলো যেন মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে নেন এবং বাল্যবিয়ে না দেন। এতে করে ওই পরিবারগুলো আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে দরিদ্রতা জয় করছে।