• মে ৯, ২০২৪ ২:৪৪ অপরাহ্ণ

রোহিঙ্গা নেতার ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে দোয়া!

সেপ্টে ১৬, ২০২০

আরাকানের মজলুম রোহিঙ্গাদের বিপ্লবী নেতা কাশেম রাজার ছেলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলমকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়ায় আরজ জানিয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা। রাজা শাহ আলম উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মসজিদে মসজিদে খতমে কোরআন শেষে দোয়া মাহফিলে এ আরজ জানানো হয়।

এমন একটি ভিডিও সোমবার রাতে প্রচার পাওয়ার পর কক্সবাজারজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকে বলছেন, মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব বাগিয়ে নেয়া রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে এদেশে স্থায়ী হতে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ এ দোয়ার উচ্চারণ। কৌশলে বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব কব্জা করা রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে অভিমত বোদ্ধা মহলের।

সূত্রমতে, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি হোটেল ব্যবসায়ী শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম সম্প্রতি উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হয়েছেন। ইতোমধ্যে ৩৩ সদস্যের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছেন তিনি। রাজা শাহ আলম রোহিঙ্গাদের বিপ্লবী নেতা কাশেম রাজার ছেলে। ষাটের দশকে মিয়ানমার সরকারের চাপের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন কাশেম রাজা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীর পাহাড়ি এলাকায় সপরিবারে আশ্রয় নেন তিনি। পরে ওই এলাকায়ই বসতি গড়ে থিতু হন নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের বিপ্লবী এই নেতা। সেখানে জন্ম হয় কাশেম রাজার তিন ছেলে ও দুই মেয়ের। কাশেম রাজার প্রথম সন্তান শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম।

সূত্র জানায়, সত্তরের দশকে মিয়ানমারের গুপ্তচররা উখিয়ার ইনানীর পাহাড়ি এলাকায় কাশেম রাজাকে হত্যা করে। এরপর পরিবারের হাল ধরেন রোহিঙ্গা নেতার বড় ছেলে রাজা শাহ আলম। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য বাবার মতো সক্রিয় লড়াই করার পরিবর্তে পরিবার গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেন। শুরু করেন মাছের ব্যবসা। ধীরে ধীরে ব্যবসায় সফলতার হাত ধরে কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টে হোটেল মিডিয়া নামের একটি পর্যটনসেবী আবাসন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন।

এভাবে বিত্তবৈভবের মালিক হলেও পিতার আদর্শ ভুলে যাননি তিনি। খবর রাখেন জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের। জনশ্রুতি আছে, যেকোনো সমস্যায় তার কাছে গেলে তিনি বিমুখ করেন না। বিপন্নরা রোহিঙ্গা হলে খাতির পান একটু বেশি। কাশেম রাজা সম্পর্কে অবগত রোহিঙ্গারা রাজা শাহ আলমকে নিজেদের ‘আশ্রয়স্থল’ বলে মনে করেন।

স্থানীয় সূত্র মতে, পর্যটন ব্যবসায় সম্পৃক্ততার সূত্রে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে চলে আসেন রাজা শাহ আলম। যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে সে দলের ক্ষমতাধরদের আস্থাভাজন হিসেবে থেকেছেন। কোনো দলে তার এককভাবে সম্পৃক্ততার কথা শোনা যেত না। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজা শাহ আলম কক্সবাজার সার্কিট হাউস এলাকায় সড়ক লাগোয়া একটি বহুতল ভবন গড়েন। সেই ভবনেই উখিয়া-টেকনাফের সাবেক বিতর্কিত সাংসদ এবং রোহিঙ্গাদের কাছেরজন হিসেবে পরিচিত আব্দুর রহমান বদি ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ সিআইপিকে নামমাত্র মূল্যে একেকটি ফ্ল্যাট উপহার দেন। তখন থেকেই আওয়ামী রাজনীতিতে নাম যুক্ত হয় রাজা শাহ আলমের। সেবার জেলা কমিটিতে অর্থ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পান তিনি। বাড়তে থাকে তার প্রতিপত্তি। বাবার সুবাদে তার বড় ছেলেও জেলা যুবলীগের প্রস্তাবিত কমিটির অর্থ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন।

এদিকে নানাভাবে জেলা নেতাদের সুনজরে থাকায় গত ৯ সেপ্টেম্বর ঘোষিত উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পান শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলম। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরীসহ ত্যাগী অনেক নেতাকে নিয়ে ৩৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও ঘোষণা করা হয় সম্প্রতি। এ নিয়ে উখিয়ায় সরকারদলীয় রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। এ খবর চাউর হয় রোহিঙ্গা শিবিরেও। সচেতন রোহিঙ্গারা খবরটি সবার মাঝে ছড়িয়ে শোকরিয়া জ্ঞাপন করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা বলেন, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক আমাদের ওপর চালানো জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাশেম রাজা প্রতিবাদ করতেন বলে জেনেছি। তারই সন্তান রাজা শাহ আলম। কওম হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ তিনিও বোঝেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদেরই একজন বাংলাদেশের সরকারি দলের বড় পদে এসেছে এটা আমাদের জন্য শোকরিয়ার। আমরা মসজিদে খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিল করেছি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ২ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথমে কাশেম রাজার ছেলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রাজা শাহ আলম উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হওয়ায় শোকরিয়া জানানো হয়। পরে তাকে বড় পদে নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিতে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়ায় আরজ জানিয়েছেন কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের মাওলানারা।

এদিকে ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে আনন্দ প্রকাশ হলেও চরম অসন্তোষ চলছে উপজেলার আওয়ামী লীগসহ জেলার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক শাহ আলম চৌধুরী ওরফে রাজা শাহ আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, নিয়মমতে পরিচ্ছন্ন যে কেউ দলে সম্পৃক্ত হতে পারেন। শাহ আলম চৌধুরীও আমাদের মাঝে তেমনই একজন। কেউ কারো জন্য শুভকামনা বা কোনো বড় কিছু প্রত্যাশা করে দোয়া করলে সেটার দায় দোয়াকারীদের ওপর বর্তায়। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কামনা একটু বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হলো।