বিশেষ প্রতিবেদক:
কুড়িগ্রাম জেলায় নামমাত্র এতিম ও দুস্থ শিশু দেখিয়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। বিভিন্ন এতিম খানা ঘুরে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের চিত্র। বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের এই মহোৎসব চললেও নজরদারী নেই প্রশাসনের। এসব নিউজ না করে জেলার কর্মসংস্থান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের নিউজ করার পরামর্শ কর্মকর্তার।
তথ্যানুসন্ধানে দেখাযায়, জেলার ৮উপজেলায় নিবন্ধিত বেসরকারি এতিমখানা রয়েছে ২১টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২হাজার ৭২জন। এরমধ্যে ক্যাপিটেশন বা সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগী শিক্ষার্থী ৯২৬জন। এসব এতিম শিশুদের জন্য চিকিৎসা, খাওয়া এবং পোশাক বাবদ প্রতিমাসে জনপ্রতি দু’হাজার করে। এরমধ্যে খাদ্য বাবদ ১৬০০টাকা, পোষাক-২০০টাকা, ঔষধ ও অন্যান্য ২০০ টাকা ব্যয় করার শর্ত রয়েছে। জেলার সরকারি একটি এতিমখানার ৫৫জন শিশুর জন্য মাসে জনপ্রতি চার হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। গেল ২০২১-২২অর্থবছরে জেলায় ৯৮১জন এতিম শিশুর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ২কোটি ৪৮লাখ ৬৪হাজার টাকা। বিধি মোতাবেক এতিমখানাতে ন্যূনতম ১০জন ৬হতে ১৮ বছরের এতিম নিবাসী থাকতে হবে। শতভাগ নিবাসী প্রাথমিক/মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত সাপেক্ষে শতকরা ৫০ভাগ শিশু এ সেবার আওতায় আসবে। তবে এ ব্যাপারে সরকারি কোন নিয়ম নীতি মানছেন না শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। এতিমদের খাবারের বরাদ্দকৃত টাকা শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের কিছু অসাদু কর্মকর্তারা ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার অভিযোগও রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়মানুযায়ী যেসব শর্তে বরাদ্দ আসে তার ছিটে ফোঁটাও নেই বেশির ভাগ এতিমখানায়।
সরেজমিনে দেখাযায়, নাগেশ^রী উপজেলার সমশের আলী শিশু সদনে নিবাসী ১১০জনের মধ্যে ৫০জন এতিম শিশুর জন্য বছরে বরাদ্দ দেয়া হয় ১২লাখ টাকা। অথচ উপস্থিত এই শিশু সদনে ১৫জন শিশুর দেখা পাওয়া যায়। সরকারিভাবে ৫০জনের বরাদ্দ পেলেও কাগজ কলমে রয়েছে ৩৫জন শিশু। পূর্ব সাপখাওয়া আজিজিয়া হাফেজিয়া লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানায় ১৩০জনের বিপরীতে ৫৫জন।
রৌমারী উপজেলার টাপুরচর দারুল উলুম এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ১৮০জন নিবাসীর মধ্যে বরাদ্দ ১০০জনের জন্য ২২লাখ ৮০হাজার টাকা হলেও সেখানে উপস্থিত শিশু রয়েছে ১৫জন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে কোন এতিম শিশু নেই। বায়তুল ক্বারার গোলাম হাবিব শিশু সদনে নিবাসী ১৫০জনের মধ্যে ৭০জনের জন্য ১৫লাখ ৬০হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও উপস্থিত শিশু রয়েছে ২৫জন। সরেজমিনে পাওয়া রাসেল,সেলিম মিয়া,আব্দুর রহমান, সুমন মিয়া, মিরাজ, অন্তর, সামিউল আশিক, সবুজ, জুনায়েদ, কাদের, সৌরভ,রাসেল,মামুন,ফরহাদ, নাছিরসহ ছাত্রদের সবারই পিতা-মাতা বেঁচে আছেন।
উলিপুর উপজেলার জুম্মাহাট হাফিজিয়া কারিয়ানা মাদ্রাসা আদর্শ এতিম খানাতেও একই চিত্র। এখানে ৮৬জন নিবাসীর মধ্যে ৫৪জনের জন্য ১২লাখ ২৪হাজার টাকা বরাদ্দ আসলেও উপস্থিত পাওয়া যায় ৩০/৩৫জন শিশু। এছাড়াও ঠুটা পাইকর ইদ্রিসিয়া জামানিয়া শিশু সদনে ৭০জন নিবাসীর মধ্যে ৩৫জন ক্যাপিটেশন পায়। বজরা হোসাইনিয়া শিশু সদন ৯০জনের মধ্যে ৩০জন,সাতঘড়ি নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় নিবাসী ১০০জনের মধ্যে ৫০জন।
চিলমারী উপজেলায় গোলাম হাবীব শিশু সদনে ৬৬জনের মধ্যে ৩০জন,থানাহাট হাফিজিয়া আদর্শ ইসলামিয়া শিশু সদনে ৭২জনের মধ্যে ৫৬জন।
রাজারহাট উপজেলায় সিরাজী এতিমখানায় ৩০জনের মধ্যে ১৫জন,বরকতিয়া ইসলামিয়া বালিকা শিশু সদনে ৭৮জনের মধ্যে ৩৫জন।
ফুলবাড়ি উপজেলায় আব্দুল আজিজ সরকার ও সামিয়া আজিজ এতিমখানায় ৬০জনের মধ্যে ৩০জন, মরহুম ডা: নজির হোসেন খন্দকার এতিমখানায় ৮৫জনের মধ্যে ২৬জন,খড়িবাড়ি ফাতেমা এতিমখানায় ৬৩জনের মধ্যে ৪০জন, দাশিয়ারছড়া কালিরহাট এতিমখানায় ৭০জনের মধ্যে ৩০জন।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় মোহাম্মদিয়া আল আবিব আল ফজরিয়া এতিমখানায় ৮০জনের মধ্যে ৪০জন এবং কুড়িগ্রাম সদরের এছহাকিয়া শিশু সদনে ৩০০জনের মধ্যে ৪০জন। ইউসিডি মহিউচ্ছুন্নৎ নাছিরিয়া এতিমখানায় ১০০জনের মধ্যে ৬০জন ক্যাপিটেশন কিংবা সরকারের দেয়া বরাদ্দের সুযোগ সুবিধার তালিকা প্রাপ্ত। কিন্তু কাগজ কলমে এসব শিশুর সংখ্যা শতভাগ ঠিক রাখা হলেও সরেজমিনের সাথে কোন মিল নেই। এছাড়াও জেলার একমাত্র সরকারি শিশু পরিবার(বালক) ১০০জনের মধ্যে ৫৫জন ক্যাপিটেশনের আওতায় রয়েছে।
সমশের আলী শিশু সদনে ছাত্র আল আমিন বলেন, আমাদের এখানে ৩৫জন ছাত্র থাকি। তবে ১৫জন রাতে থাকা ও খাওয়া হয়। ভাত,ডাল, আলু ভর্তা,সবজি সকাল-রাতে এবং ব্রয়লার মুরগীর গোশত, পাঙ্গাস মাছ,ডিম মাঝে মধ্যে দুপুরে দেয় খেতে।
এই এতিমখানার সাধারণ সম্পাদক খবির উদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেন তাদের ৫০জনের বরাদ্দ আসে। তবে নিয়মিত ৩৫জন এতিম শিশু খাওয়ানো হয়। আগামীতে এমন অনিয়ম না করার শর্তে তিনি এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।
জুম্মাহাট হাফিজিয়া কারিয়ানা মাদ্রাসা আদর্শ এতিম খানার ছাত্র মিল্লাদ ইসলাম বলেন,গোশত,ডিম,সবজি দেয় খেতে। তবে এই এতিম খানায় নিয়মিত ৩০/৩৫জন থাকা খাওয়া করেন।
এই এতিম খানার কমিটির সাবেক সদস্য আবু বকর সিদ্দিক বলেন, তছরুপের পদ্ধতিটা হলো এতিমখানায় কিছু ভাড়াটিয়া ছাত্র আছে। এদের সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ আছে। পরিদর্শনে আসার আগে খবর দিয়ে আসে। সেসময় এই ভাড়াটিয়া ছাত্রদের দেখানো হয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বর্তমান যারা আছেন তাদের মধ্যে ১২/১৩জনের বেশি এতিম নেই এখানে।
বায়তুল ক্বারার গোলাম হাবিব শিশু সদনের ছাত্র হৃদয় বলেন,আমাদের এখানে প্রায় ২৫জন শিশুর জন্য খাওয়া দাওয়া করানো হয়। এতিমখানা থেকে বছরে দু’বার পাঞ্জাবী ও পায়জামা দেয়।
টাপুরচর দারুল উলুম এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় কয়েক জন শিশু নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের এই এতিম খানায় ৩০/৩৫জন শিশু আছি। এখানে কেউ এতিম নেই। সবারই বাবা-মা আছে। এছাড়াও এই এতিমখানার শিশুদের দিয়ে গ্রামে গ্রামে চাঁদা তোলা হয়। চাল,টাকা ইত্যাদি তুলে এতিমখানায় দেয়া হয়। তাই দিয়ে এতিমখানা চলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন,এতিম শিশু না থাকলেও সমাজসেবা কর্মকর্তা কাবিল আহমেদকে প্রতি বিলের সময় ৪০/৫০হাজার টাকা দিতে হয়। সে উদ্ধর্তন কর্মকর্তা,ট্রেজারিসহ সবকিছু সম্বনয় করেন। এভাবেই চলছে। এতিম শিশু না থাকলেও থাকা,খাওয়া এবং কমিটি,শিক্ষকসহ বাকি টাকা খরচ হয়ে যায়।
কুড়িগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রোকোনুল ইসলাম অনিয়মের কথা স্বীকার করেন করে বলেন, ফুলবাড়ি, নাগেশ^রী, উলিপুরে,চিলমারী,সদরসহ বেশ কয়েকটি এতিমখানায় অনিয়ম আছে। তার উপরেও এতিম শিশুর ৮/১০ করে বেশি দেখানোর জন্য সচিবের পিএস লুকাস কিবরিয়া এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের চাপ রয়েছে। স্থানীয় এমপির এতিমখানাতেও আমরা ঘাপলা পেয়েছি। খবর পেয়ে এমপি আমার এখানে ছুটে আসল। এরপর তিনি আর কথা না বাড়িয়ে এসব নিউজ না করে জেলার কর্মসংস্থান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিনিধিকে নিউজ করার পরামর্শ দেন তিনি।