• এপ্রিল ২০, ২০২৪ ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

কুড়িগ্রাম দু’রাষ্ট্রের এক মসজিদঃ সম্প্রীতি আর সৌহার্দে দৃষ্টান্ত

অক্টো ২৬, ২০২০

বিশেষ প্রতিবেদক:

রাষ্ট্র ভাগ হলেও হয়নি ভাগ সম্পর্ক। ব্রিটিশ আমলে (প্রায় ২শ বছর আগে) তদানিন্তন ভারতের প্রত্যন্ত এলাকায় পূর্ব পুরুষরা তৈরি করে একটি মসজিদ। ব্রিটিশ শাসক চলে গেছে ভারত-বাংলাদেশ ভাগ হয়েছে। সীমান্ত ঘেরা হয়েছে কাঁটাতার দিয়ে। তবু সম্প্রতি আর বন্ধন ভাগ করতে পারেনি। একটি মসজিদকে ঘিরেই মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিকদের।
এই আজানের ধ্বনি শুনে যে কারোই মনে হবে এটি একটি সাধারণ মসজিদের আজান। কিন্তু আসলে এই আজান হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে ১৫শতক জমির উপর নির্মিত মসজিদের। প্রায় ২শ বছর আগে তৈরি করা হয় এই ঝাকুয়াটারী জামে মসজিদ। বর্তমানে সীমান্তের এই মসজিদ দু’রাষ্ট্রের মানুষের মেলবন্ধন তৈরি করেছে। ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্ত ঘটলে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়েছে। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূ-খন্ডের জন্ম হলে ভারত সীমান্ত জুড়ে নির্মাণ হয় কাঁটাতারের বেড়া। দু’রাষ্ট্রের ভিন্ন নাগরিক হলেও সমাজ ব্যবস্থা আর আত্মীয়তার সম্পর্ক তাদের দীর্ঘ দিনের। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও আজও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এই এলাকায়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আন্তর্জাতিক মেইন পিলার নং-৯৭৮ এর সাব পিলার ৯ এস’র পাশে দুই বাংলার মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদকে ঘিরে উত্তর দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানার গাঁড়ালঝাড়া গ্রাম। আর দক্ষিণে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি ঝাকুয়াটারি গ্রাম। ভারতের অংশটি কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে পরে যায়। গ্রামটি আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার দিয়ে ভাগ হলেও ভাগ হয়নি তাদের সমাজ। ভিন দেশের নাগরিক হলেও প্রতিবেশীর মতই তাদের বসবাস। তবে আচরণ, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের নিজস্ব ভঙ্গিতে ভারতীয়রা বাংলা ভাষায় কথা বলেন এবং সেই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের অংশে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার ভঙ্গিতে কথা বলে থাকেন। ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন দেশ হলেও তারা একই সমাজের বাসিন্দা, একই মসজিদের মুসুল্লী। বাংলাদেশের বাঁশজানি ঝাকুয়াটারী গ্রামে ৪৫টি পরিবারের তিন শতাধিক এবং ভারতের গাঁড়ালঝাড়া গ্রামে ৪৫টি পরিবারের প্রায় আড়াইশ মানুষের বাস। জমিজমা ও বসতভিটা থাকায় তারা কাঁটাতারের অভ্যন্তরে চলে যাননি। তাদের মধ্যে কোনদিনই ঘটেনি কোন ঝগড়া বিবাদ ও জটিলতা।
বাংলাদেশী নাগরিকরা জানান, দেশভাগ হলেও সমাজ এবং মসজিদ ভাগ হয়নি। দুই দেশের আইনি জটিলতার প্রভাব পড়েনি। ঐতিহ্যবাহী এই সীমান্ত মসজিদ দেখতে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরাও আসেন। অনেকেই এই মসজিদে নামাজ পড়ে কালের স্বাক্ষী হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন তারা।
ভারতীয় নাগরিকরা জানান, সীমান্তের এই মসজিদ প্রায় ২শ বছরের পুরনো হলেও অবকাঠামোগত কোন উন্নতি হয়নি। সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণে আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা থাকায় এটি সম্ভবও হচ্ছে না। দুই বাংলার মানুষেরা যৌথভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামত করে থাকেন। শিশুদেরও মাঝে গড়ে উঠছে পূর্ব পুরুষের দেখিয়ে দেয়া পথ। দুই দেশের শিশুরা মিলেমিশে খেলাধুলা করে আসছে অনায়সে।
এ ব্যাপারে ঝাকুয়াটারী জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন নজরুল ইসলাম জানান, আযানের ধ্বনিতে দুই বাংলার মুসিল্লরা ছুটে আসেন নামাজ পড়তে। এক সাথেই আদায় করেন নামায। একাকার হয়ে যায় একে অপরের প্রীতি ভালোবাসা। মসজিদ থেকে বেড়িয়ে কোলাকুলি করেন দুই বাংলার মানুষ। নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেন কুশলাদি। শুক্রবার জুম্মার নামাযের দিন সীমান্তে এই মসজিদটি আরো বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। বাংলাদেশ ও ভারতের মুসল্লিরা পাতিল-বালতি ভরে নিয়ে আসেন তবারক। তারা সীমান্তে একে অপরের মাঝে দু:খ বেদনা ও সুখের কথা আদান প্রদান করে থাকেন। একই সমাজভূক্ত হওয়ায় একে অপরের বিপদে-আপদে ছুটে আসেন বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরন্নবী চৌধুরী বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রতির প্রতীক হয়ে। ঐতিহাসিক এই মসজিদটির মাধ্যমে দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রামকে তুলে ধরার জন্য এই মসজিদ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে প্রকল্প নেয়া হবে।