• মে ৫, ২০২৪ ৯:১১ পূর্বাহ্ণ

কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি; একজনের মৃত্যু

জুন ১৯, ২০২২

স্টাফ রিপোর্টার:

দ্রুত গতিতে নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। রবিবার বিকেল ৩টায় ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে এখনো ২৬ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে বইছে। পানি বৃদ্ধির ফলে মৎস্য বিভাগের ৫৩ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফসল তলিয়ে গেছে ১০ হাজার ৮৯৪ হেক্টর জমিতে এবং সাড়ে ১১ লক্ষ টাকার প্রাণিসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। চলমান বন্যায় উলিপুরের দুর্গাপুরে মাকসুদা জান্নাত (১১) নামে একটি মেয়ে পানিতে পরে মারা গেছে।
এদিকে বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও জ¦ালানীর তীব্র সংকট। কাজ বন্ধ হওয়ায় দিনমজুর পরিবারগুলোর ঘরে খাদ্য সংকট প্রকট হয়েছে। চারণভূমি ডুবে যাওয়ায় গবাদী পশুর খাদ্য মিলছেনা। চরাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে হাট বাজার যাতায়াতসহ যোগাযোগের চরম ভোগান্তিতে পড়েছে বানভাসী মানুষ। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে এবারে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রৌমারী উপজেলা।
এই পরিস্থিতিতে কুড়িগ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ৮৫টি মেডিকেল টিম, ৯ উপজেলায় একটি করে মনিটরিং টিম এবং সিভিল সার্জন অফিসে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে ১৮টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
রবিবার থেকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস উপজেলাগুলো থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য নেয়া শুরু করেছে। এই বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানান, আজকের সকালের তথ্য অনুযায়ী ৪৯টি ইউনিয়নে ৮৭ হাজার ২৩২জন মানুষ পানিবন্দী হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বন্যা কবলিতদের জন্য এ পর্যন্ত ৩১৩ মে.টন চাল, নগদ ১৪ লাখ টাকা, পশু খাদ্য বাবদ ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, শিশু খাদ্য বাবদ ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সবগুলো উপজেলা ও ইউনিয়নগুলো থেকে তথ্য উঠে না আসায় পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যাবে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইউপি সদস্য, সংবাদকর্মী ও বিভিন্ন সূত্রে সংবাদ পাওয়া গেছে।
এদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালিপদ রায় জানান, চলতি বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৩ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে ৭৪২টি পুকুরের ৭০৫জন মৎস্য চাষীর ১১৫ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল হাই সরকার জানিয়েছেন, বন্যায় প্রায় অর্ধশতাধিক মুরগী মারা গেছে। এছাড়াও গো-চারণভূমি, খড় ও দানাদার শষ্য তলিয়ে যাওয়ায় ১১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ১৮টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম খামার বাড়ীর উপপরিচালক মো. আব্দুর রশীদ জানান, এখন পর্যন্ত বন্যায় ১০ হাজার ৮৯৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে ৬ হাজার ৮০৬ হেক্টর জমির পাট ক্ষেত রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কর্মকর্তাগণ পরামর্শ দেয়াসহ তথ্য সংগ্রহ করছেন।
সিভিল সার্জন ডা.মঞ্জুর-এ-মোর্শেদ জানান, বন্যার্তদের সহয়োগিতায় জেলায় মেডিকেল অফিসারের নেতৃত্বে ৮৫টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলায় ৯টি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগে একটি কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। মেডিকেল টিমের সদস্যরা বন্যা কবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, কলেরা স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। এছাড়াও তিনি জানান, উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের যমুনা সরকারপাড়া গ্রামের মাঈদুল ইসলামের কন্যা মাকসুদা জান্নাত (১১) শনিবার দুপুর সাড়ে ১১টায় বাড়ীর পাশে বন্যার পানিতে পরে মারা গেছে।
এদিকে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মুড়িয়ারহাট এলাকায় দুধকুমার নদের একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে আরো ৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে শুক্রবার সকালে এই বাঁধটি ভেঙে যায়। দুধকুমর নদীর কালিগঞ্জ, বামনডাঙ্গা ও ধাউরারকুটি এলাকায় বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই এলাকায় ৪৮ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আগামি সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু করা হবে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোব, বাংটুরঘাট ও গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাপুর বাজার সংলগ্ন ক্রস বাঁধটি ঝুঁকিতে রয়েছে ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, নাগেশ^রীতে বেড়িবাঁধের ৫০ মিটার পানির তোরে ধসে গেছে। বন্যার পানি আরো তিনদিন বাড়তি অবস্থায় থাকবে। এরপর পানি কমে নিম্নগামি হবে।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল আলম রাসেল জানিয়েছে, এই উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের সবকটিই এখন বন্যাকবলিত। পানিবন্দী রয়েছে ৫০ হাজারের উপর মানুষ। সাড়ে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ রৌমারী-ইজলামারী সড়ক নিমজ্জিত থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রৌমারী শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রুহুল আমিন জানান, বন্যায় দুর্গম চরাঞ্চলে যাতে চুরি ও নৌ-ডাকাতি না হয় এজন্য বিচ্ছিন্ন এলাকায় পুলিশী টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। কোথাও ত্রাণ দিলে পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। এছাড়াও বন্যা কবলিত এলাকায় প্রচার-প্রচারণা ও উঠান বৈঠক করা হচ্ছে।
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যার প্রস্তুতি হিসেবে জেলা প্রশাসক দপ্তরে একটি সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও আইন শৃংখলা সঙ্গে জড়িত কর্মকতা কর্মচারিদের কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ৩৬১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আজ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সকল দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতিদিনের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রদান করতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলায় ২০ লক্ষ টাকা এবং ৪০৭ মেট্রিকটন চাল মজুদ রয়েছে। এছাড়াও আরো ৫০০ মেট্রিকটন চাল ও ২০লক্ষ টাকার চাহিদা দেয়া হয়েছে।