• মে ২১, ২০২৪ ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

চলতি বছর ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা

সেপ্টে ১৬, ২০২০

দেশে গত অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মে.টন। যেখানে ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার মে.টন। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার মে.টনে হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী ৫ বছরে ইলিশের উৎপাদন বাড়বেই বিশেষজ্ঞদের মতে।
দীর্ঘ দুই মাস অলস সময় কাটানোর পর নদীতে মাছ ধরতে নদীতে নেমেছে হাজার হাজার জেলে। এ কারণে স্বস্তি ফিরে এসেছিল জেলে পরিবারগুলোতে।
কর্তৃপক্ষের দাবি জাটকা রক্ষার কর্মসূচি সফল হওয়ায় এ বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা জানান ইলিশ উৎপাদনের বিষয়টি জলবায়ুর ওপরেও অনেকটা নির্ভর করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো কারও একার পক্ষে সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে সমুদ্র ও নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র রক্ষার ওপরেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ২০শে মে থেকে ২৩শে জুলাই, টানা ৬৫ দিন ইলিশ আরোহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মৎস্য অধিদফতর। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তারও অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ মাছ ধরার স্বাভাবিক কার্যক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায় চট্টগ্রাম নগরীর বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্র নগরীর ফিশারি ঘাটে এখন প্রাণচাঞ্চল্য। ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালী ইলিশ। জেলেদের হাক ডাকে মুখর এখন ফিশারি ঘাট। সকাল থেকে নৌকা ভর্তি করে ইলিশ মাছ নিয়ে নগরীর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ফিরছেন জেলেরা। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সাগরে প্রচুর মাছ ধরা পড়ায় খুশি তারা।কাঙ্খিত রুপালী ইলিশ ধরা পড়ায় এ হাসি ট্রলার মালিক ও আড়ৎদারদের মুখেও হাসি।
অপরদিকে ঠিক উল্টো চিত্র চট্টগ্রাম নগরী হালিশহর দক্ষিণ কাট্টলী, আনন্দ বাজার ও পতেঙ্গা এলাকার ঘাট গুলোর। ছোট ছোট বোট গুল্রো প্রান্তিক জেলেরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছে।
এতো দীর্ঘ বিরতির পর ২৩শে জুলাই রাত থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর থেকে জেলেরা ট্রলার, বোট বোঝাই করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ সংগ্রহ করবে এই আশায় বুক বেঁধেছিল চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী,আনন্দ বাজার ও পতেঙ্গা এলাকার ঘাট গুলোর জেলে থেকে শুরু করে আড়তদার ব্যবসায়ী,মাছ ব্যবসায়ী ও ইলিশ দাঁদনরা। কিন্তু হিতে বিপরিত।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও আড়তদার কায়সারুল আমিন তুহিন বলেন চলতি বছর নানা কারণে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন, সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এখনপর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কিছুটা বেশি উৎপাদিত হলেও বাকি সময়ের মধ্যে উৎপাদন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন নগরীর ফিশারি ঘাটে বড় বড় ফিশিং বোট গুলো কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনতে পাড়লেও প্রান্তিক, ক্ষুদ্র জেলেরা ছোট ছোট বোটে করে পর্য্প্তা মাছ আহরণ করতে পারছেনা। এ কারণে আড়তদার ,ব্যবসায়ী ও দাদনরা ঋণ গ্রস্থ হয়ে পড়ছে।তাছাড়া নগরীর অন্যতম ফিশারী ঘাঠে প্রায় ৮/৯ হাজার বড় বড় ফিশিং বোট থাকায়, কয়েকটা ফিশিং বোটের মাছ এক জায়গায় রাখলে প্রচুর মাছ দেখা যায় কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন চিত্র। মাত্র ২/৩ টা বোট মাছ পেলেও, অন্যান্য বোট পর্য্প্তা মাছ পাচ্ছেনা।
ইলিশকে ঘিরেই দীর্ঘ ৬৫ দিন ঝিমিয়ে থাকা চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলী,আনন্দ বাজার ও পতেঙ্গা এলাকার ঘাট গুলো কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবে লঘুচাপের কারণে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠায় জেলেদের মুখের হাসি অনেকটাই মলিন হতে বসেছে।
সপ্তাহের শুরু থেকেই বৈরী আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রে যেতে পারেননি জেলেরা। বর্তমানে আবহাওয়া মাছ শিকারের উপযোগী। বঙ্গোপসাগরে ধরাও পড়ছে প্রচুর ইলিশ। কিন্তু চট্টগ্রামের উপকূলের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পতেঙ্গা উপকুলীয় জেলেরা, হালিশহর বারণীঘাট সহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন মৎসকেন্দ্রে, মৌসুমের শুরুতেই বিরূপ আবহাওয়া জেলেদের মধ্যে নতুন করে উদ্যোগের সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্র উত্তাল থাকায় অনেক ফিশিং বোটই ফিরে এসেছে তীরে। ফলে শনিবার থেকে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে মৎস অবতরণ ও বন্দরগুলো। বন্দরগুলো ফেরত আসা বোটগুলোতে যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে তাই সম্বল বাজারের। এ ছাড়াও বরফের অভাবেও ইলিশ ব্যবসায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
জেলেরা বলছেন, সাগর উত্তাল হয়ে ওঠলে মাছ ধরা সম্ভব হয় না, আর বর্তমান বৈরী আবহাওয়ার কারণে উত্তাল থাকায় সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ বললেই চলে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ও বৃষ্টি হলে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশাবাদী তারা।
দক্ষিণ কাট্টলী রাসমণি ঘাট মৎস কল্যাণ সমবায় সমিতির অর্থ সম্পাদক মো: মুজিব বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর থেকে আবহাওয়ার কারণে হঠাৎ সাগর উত্তাল হওয়ায় মাছ শিকার বন্ধ করে জেলেরা তীরে ফিরে এসেছেন। যে মাছ নিয়ে এসেছেন তা খুবই সামান্য। ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বরফ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বরফ সংকটে সমুদ্রে যেতে পারছে না জেলেরা।এ সব বিভিন্ন কারণে ঘাটে বসে অলস সময় পার করছে শতাধীক ট্রলার। তারপরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বরফ সংগ্রহ করে কিছু ট্রলার সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকার করে ঘাটে ফিরলেও আহৃত ইলিশ সংরক্ষণ করতে পারছে না। ক্রেতারাও মাছ কিনতে অনিহা প্রকাশ করছে।
জেলে মোবারক হোসেন বলেন, ৬৫ দিন অবরোধের কারণে পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে সময় কাটাতে হয়েছে। এখন মাছ শিকারে গিয়ে যদি আবহাওয়া অনুকূলে না থাকে তবে লোকসান ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এরকম হলে আমাদের এই পেশা থেকে সরে আসতে হবে এবং আমাদের ধারণা আস্তে আস্তে মৎস্য শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বর্তমানে খুব খারাপ অবস্থায় আমরা আছি, এ পেশা ছেড়ে দিবো ভাবছি।
মৎস্যজীবী মো: সুলতান শেখ বলেন, এই ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে একের পর এক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে জেলেরা, যার কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ট্রলার মালিক ও জেলেরা। কেউ কেউ দুর্যোগ উপেক্ষা করে সাগরে গেলেও জাল ছিঁড়ে এবং তুফানের কারণে ট্রলার ভেঙে খালি হাতে ফিরে আসছে উপকূলে। তাই জেলেদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। যাতে সামনের দিনগুলোতে জেলেরা বেঁচে থাকতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য। পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা ১৫ দিন পরে হাতে মাছ ধরার আরএকটি জো হাতে পেলে ২২দিনের নিষেধাজ্ঞায় অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটতোনা।
খেঁজুরতলী ঘাট, রাসমণি ঘাট ও ডগের খাল ঘাট এই তিনটি ঘাট মিলে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমণি ঘাট মৎস কল্যাণ সমবায় সমিতি।
দক্ষিণ কাট্টলী রাসমণি ঘাট মৎস কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি মো: ইউছুফ বলেন বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর থেকে ইলিশের দেখা মিলতে শুরু করে। তবে বর্তমানে আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় গত ২ দিনে ইলিশের আমদানি কমে গেছে। এতে কাজের চাপ কমে শ্রমিকদের রোজগারও কমে গেছে। সাগরে মাছ শিকারে নেমে দু’দিন যেতে না যেতেই সাগর উত্তাল হতে শুরু করে। ফলে শুক্রবার ও শনিবার স্থানীয় বেশিরভাগ ফিশিংবোট ফিরে এসেছে। যা নোঙর করা থাকলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে। বৈরি আবহাওয়ায় লক্ষ লক্ষ জাল ছিঁড়ে গেছে, কারো কারো বোট ভেঙ্গে গেছে, মাঝিও মারা গেছে। এর প্রভাব শুধু ব্যবসায়ী নয়, জেলে-শ্রমিক, বোট মালিকসহ সবার ওপরে পড়বে।
এতে করে ২ দিন আগের থেকে রোববারের বাজারে ১ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ইলিশের দর আকার অনুযায়ী মণপ্রতি বেড়ে গেছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
সাগর থেকে ফিরে আসা রহিজুল মাঝি জানান, আমাদের অভাবের কথা বলে শেষ করতে পারবো না! সাগরে মাছ নেই। আমরা সাগরে গেলে ১ থেকে দেড় লাখ টাকার বাজার করে নিয়ে যাই, সেখানে গেলে ঝড়ের কবলে পড়তে হয়। যতটুকু সময় থাকতে পারি তাতে ৪ থেকে ৫টি আবার কখনো ১৫ থেকে ২০টি মাছ পাই তাতে ১টি মাছের দাম পড়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আমরা শেষ, সাথে আমাদের মহাজনও শেষ। আমাদের মাছের সিজন শেষের সাথে আমাদের এই এলাকা থেকে পালিয়ে অন্যএ চলে যেতে হবে, নাহলে যে দাদন টাকা নিয়েছি তা পরিশোধ করবো কিভাবে?
তারা বলেন ১লা মে থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত এ অল্পদিনে জলবায়ু পরিবর্তন কারণে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় চলতি বছর ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে।এজন্য সরকারের কাছে সকল মৎস ব্যবসায়ী, আড়তদার, জেলেদের আকুল আবেদন পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা ১৫ দিন পরে অর্থাৎ ৩০শে অক্টোবর থেকে শুরু করলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে এবং নিষেধাজ্ঞার সময়টুকু অনাহারে কাঁটাতে হবেনা।
জেলেরা মাছ ধরার নৌকা নিয়ে নদীতে মানবন্ধন ছাড়াও সভা- সমাবেশ করে জেলা প্রশাসক ও মৎস অধিদপ্তর বরাবর স্মারক লিপিও দিবেন৷ তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এই সময়ে ইলিশ ধারতে না পারলে আমরা খাবো কী?’’
সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল হক (বাবুল সরকার) বলেন, সীমিত আকারে ইলিশ আসছে। নিষেধাজ্ঞা উঠার পর থেকেই সাগরে সিগন্যাল চলছে। যার কারণে গভীর সমুদ্রে ট্রলার যেতে পারছে না। যে ইলিশগুলো আসছে, সেটা চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ। আশা করি, আগামী সপ্তাহ থেকে প্রচুর ইলিশ আসবে।
তিনি বলেন, এখন বাজারে ছোট আকারের ইলিশ চার থেকে পাঁচশ টাকায় এবং বড় আকারের ইলিশ ৮শ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেটা অনেক দাম। এক কেজি ওজনের ইলিশ ৪শ টাকার মধ্যে চলে আসলে বোঝা যাবে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে।
মৎস কর্মকর্তা মো: কামাল বলেন সাগর দূষণ, আউটারে বড় বড় জাহাজের অবস্থান,জেলেদের আধুনিকায়ন না থাকা এবং আদি জেলেদের ছোট ছোট বোটে, টং জালে মাছ আহরণ, চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী ঘাট গুলিতে মাছ না পাওয়ার অন্যতম কারণ। আর ছোট ছোট বোটগুলো উপকুলের ২/৩ মাইলের মধ্যেই মাছ ধরা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এর বাইরে গেলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা থাকতে পারে।
ক্যাপশন:
চট্টগ্রাম নগরীর বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্র নগরীর ফিশারি ঘাটে জেলেদের জালে ধরা ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালী ইলিশ। অপর দিকে ঠিক উল্টো চিত্র চট্টগ্রাম নগরী দক্ষিণ কাট্টলী রাসমণি ঘাটে এলাকা।