• মে ৬, ২০২৪ ৬:৪৮ অপরাহ্ণ

দেশে এই প্রথম আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয় সমান সমান

সেপ্টে ১৪, ২০২০

নজিরবিহীন অবস্থায় পৌঁছেছে দেশের অর্থনীতি। প্রথমবারের মতো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই খারাপ অবস্থায় ছিল। তার মধ্যে রফতানি আয় ছিল সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। তারপরে ছিল আমদানি ব্যয়। কিন্তু এখন রফতানি আয় যেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তেমনি ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমদানি ব্যয়ও। করোনার মধ্যেই অর্থনীতির এই দুই সূচক সমান হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশে এই প্রথম কোন মাসে রফতানি আয় ও আমদানি ব্যয় প্রায় সমান হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে গত অর্থবছরে প্রায় ১৭ শতাংশ রফতানি কমেছিল। শুধু জুনেই আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আড়াই শতাংশ কম রফতানি হয়। কিন্তু জুলাই মাসে রফতানির পালে হাওয়া লাগে। কিন্তু নতুন অর্থবছরের নতুন মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়। আগস্টেও ইতিবাচক ধারায় রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন। কিন্তু করোনার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায়ও মন্থর হয়ে পড়ে। ফলে জুলাই মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় কমেছিল প্রায় ২২ শতাংশ। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমে যায়। ফলে সরকার ব্যাংকঋণমুখী হয়ে পড়ে। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। তবে করোনার মধ্যেও ভাল প্রবাসী আয় আসছে। তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে। চলতি বছরের জুলাই এবং আগস্ট মাসে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ। ফলে সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয় ৩ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার, যা দিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
সূত্র জানায়. সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) হালানাগাদ তথ্যানুযায়ী চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ ৩৯১ কোটি ২০ লাখ (৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে। আর তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি করে আয় করেছে ৩৮২ কোটি ৬০ লাখ (৩.৮৩ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি যে, রফতানি আয় ও আমদানি ব্যয় প্রায় সমান হয়েছে। আর সম্প্রতি আগস্ট মাসের রফতানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তাতে দেখা যায়, আগস্টে সার্বিক রফতানি আয় এসেছে ২৯৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগস্ট মাসের আমদানি ব্যয়ের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
সূত্র আরো জানায়, গত এপ্রিল মাসে রফতানি আয়ের চেয়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেশি এসেছিল। ওই মাসে পণ্য রফতানি করে মাত্র ৫২ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আর রেমিটেন্স এসেছিল দ্বিগুণেরও বেশি ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। এপ্রিলে পণ্য আমদানি হয়েছিল মাত্র ২৮৫ কোটি ডলার, যা এক মাসের হিসাবে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৮০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের জুন মাসের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের জুন মাসে ৩৮৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। আর গত মে মাসে এসেছিল ৩৫৩ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে মে মাসের চেয়ে জুন মাসে প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে। আর এপ্রিলে এসেছিল মাত্র ২৮৫ কোটি ডলারের পণ্য, যা এক মাসের হিসাবে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পণ্য রফতানি থেকে বাংলাদেশ আয় করে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। আমদানিতে ব্যয় হয় ৪৮০ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। তাছাড়া গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভন্ন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ মোট ৫ হাজার ৬৯ কোটি ১০ লাখ (৫০.৬৯) ডলার ব্যয় করেছে। আর রফতানি থেকে আয় করেছে ৩ হাজার ২৮০ কোটি ৩০ লাখ (৩২.৮৩ বিলিয়ন) ডলার। ওই হিসাবে গত অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭৮৬ কোটি ১০ লাখ (১৭.৮৬ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৮৩ কোটি ৫০ লাখ (১৫.৮৩ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৮১৭ কোটি ৮০ লাখ (১৮.১৮ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি। তাছাড়া গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১০৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। আমদানি কমায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাইয়ে ওই ঘাটতি হয়েছে মাত্র ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মে মাসে ৩১ শতাংশ, এপ্রিলে ৪৪ শতাংশ, মার্চে ১৩ শতাংশ ও জানুয়ারিতে প্রায় ১৩ শতাংশ কম আমদানি হয়। যদিও ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানিতে দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ওই মাসে ৪৭২ কোটি ডলারের পণ্য এসেছিল। তাছাড়া গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে ৫ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। ওই অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৫ হাজার ৯৯১ কোটি ডলারের। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।
এদিকে এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে অনেক দেশে রফতানি বন্ধ ছিল, যা এখন খুলে দেয়া হয়েছে। এ কারণে কাঁচামাল আমদানি বাড়ছে, রফতানিও বাড়ছে। তাছাড়া সুরক্ষাসামগ্রী তৈরির বিভিন্ন কাঁচামালও আমদানি হচ্ছে। এ কারণে আমদানি বেড়ে গেছে। তবে আগের মতো মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে না।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডএস) গবেষক জায়েদ বখত জানান, এদেশে প্রতি মাসেই রফতানির চেয়ে আমদানি ব্যয় দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বেশি হয়েছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো জুলাই মাসে সমান হলো। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে পণ্য আমদানি ও রফতানি দুটোই আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছিল। কিন্তু জুলাই মাস থেকে রফতানি আয় বাড়তে শুরু করলেও আমদানি ব্যয় বাড়েনি। তাই এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দেখা গেল।