• মে ৩, ২০২৪ ৪:৫৮ পূর্বাহ্ণ

দেশজুড়ে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনে দীর্ঘদিন পর নতুন করে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার

সেপ্টে ১২, ২০২০

বিশ্বজুড়েই আর্সেনিক রয়েছে। তবে বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে দূষণের মাত্রাও। আর্সেনিক দূষণমুক্ত করতে বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিগত ২০০৩ সালে টিউবওয়েলে আর্সেনিক শনাক্তকরণ প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সাধারণ ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও নদীর পাশে চামড়া প্রক্রিয়াজাতের কারণে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ১৬ বছর পর আবারো আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ প্রকল্প শুরু হচ্ছে। সেজন্য এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য দেশের ৫৪ জেলায় ইতিমধ্যে সাড়ে ৬ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য হাতে নেয়া এই প্রকল্পটি ২০০৩ সালে জামায়াত-বিএনপি সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসাবে প্রকল্পটি আবার শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের ২০টি প্রতিক্রিয়া জানা গেছে। তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াতে চারটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া রয়েছে। থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানের কিছু এলাকা এবং চীনের মূল ভূখণ্ডেও আর্সেনিক রয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা এবং চিলিতেও আর্সেনিক দূষণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ভূগর্ভস্থ পানিতে ২০০১ সালের হিসাবানুসারে ইউনাইটেড স্টেটস এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির মাত্রার (প্রতি বিলিয়নে ১০ পার্টস) চেয়েও বেশি মাত্রার আর্সেনিক পাওয়া গেছে। ২০০৭ সালের একটি গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে, ৭০টিরও বেশি দেশের ১৩৭ মিলিয়নের বেশি মানুষ খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। কিন্তুবাংলাদেশ এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত (৫০ পিপিবি’র ওপরে) আর্সেনিক রয়েছে। তাতে মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ আর্সেনিক দূষণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে তিন পার্বত্য জেলাসহ ১০টি জেলার টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। আর ওই ১০ জেলা বাদে বাকি ৫৪ জেলায় আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি। যা কিনা মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর। আর্সেনিক থেকে মানবদেহে চর্ম রোগসহ নানা ধরনের জটিল রোগ হচ্ছে। আর ওই রোগ একবার হলে সহজে নিরাময় হয় না। দেশের প্রায় সব এলাকায় আর্সেনিকের মাত্রা বেশি থাকায় রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আর ১৬ বছর আর্সেনিকমুক্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন ওই রোগে আক্রান্ত। তাছাড়া আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগের চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদি। একবার কেউ আক্রান্ত হলে কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা নিতে হয়। মূলত পানিতে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে রোগটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনের জন্য এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বিগত ২০০৩ সালে দেশের ২৭১টি উপজেলার ৫০ লাখ নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করেছিল। যার মধ্যে ১৪ দশমিক ৫ লাখ অর্থাৎ ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত (৫০ পিপিবি’র ওপরে) আর্সেনিক পাওয়া যায়। তারপরই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু আর্সেনিক নিরসনে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত দেশের ১২ শতাংশ মানুষ আর্সেনিক দূষণজনিত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতেই সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ প্রকল্পের পিডি বিধান কুমার দে জানান, দেশের ৫৪ জেলার বেশির ভাগ নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কোনটিতে বেশি কোনটিতে কম। আর্সেনিক বিষক্রিয়া হলো আর্সেনিকবাহিত রোগ। মানবদেহে যখন আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেড়ে যায় তখন সে অবস্থাকে আর্সেনিক বিষক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দীর্ঘসময় ধরে আর্সেনিকযুক্ত পানি খেলে ওই রোগের প্রাদুর্ভাব শরীরে দেখা দেয়। যা জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, শরীরে অস্বাভাবিক ব্যথা, রক্ত আমাশয় এবং উদরাময় রোগের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশে আর্সেনিক সমস্যা বলতে বোঝানো হয় বিভিন্ন অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত হার। যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। আর্সেনিক মূলত এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই রয়েছে। কিন্তু যখনই ওই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায়, তখনই তা পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। পরবর্তীতে তা জটিল আকার ধারণ করে। নানা রোগব্যাধিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। আর্সেনিক শনাক্তের জন্য এনজিও নিয়োগ কার্যক্রম চলছে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান জানান, সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসাবে গ্রামীণ জনপদে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা। ওই অঙ্গীকারের অংশ হিসাবে আর্সেনিক মুক্ত পানি সরবরাহের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ আরো আগেই শুরু হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়। এখন পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হচ্ছে। তাই প্রকল্পের কাজ আগামী মাস থেকেই শুরু হবে। এ বছর প্রকল্পের জন্য আড়াইশ’ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে আরো সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কাজ বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নিয়োগ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এনজিও নিয়োগ হলে তারা সারাদেশের টিউবওয়েলগুলো পরীক্ষা করবে। কোন টিউবওয়েলে আর্সেনিক থাকলে তাতে লাল চিহ্ন দেবে। আর যেসব টিউবওয়েলে আর্সেনিক নেই সেগুলোতে সবুজ চিহ্ন দিয়ে রিপোর্ট দিলে আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলগুলো প্রতিস্থাপন করা হবে। জরিপ কাজের জন্য এনজিও আবেদনকারী এনজিও বাছাইয়ের কাজ চলছে। আর আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ (টিউবওয়েল) চিহ্নিত হলেই কাজের অগ্রগতি বেড়ে যাবে।